নড়াইল প্রতিনিধি:
নড়াইলের কালিয়া উপজেলার অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ চাঁচুড়ী পুরুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পত্তি অর্জন ও করোনার টীকার জন্য টাকা আদায়ের অভিযোগে এমপিও স্থগিত করে বেতন-ভাতাদি বন্ধ,ক্সদুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ তদন্তাধীন থাকা সত্ত্বেও উপজেলা পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় শিক্ষক সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সদ্য ঘোষিত জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে (২৯ এপ্রিল) শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর এই শিক্ষককে নিয়ে এলাকাজুড়ে হাসিঠাট্টা হচ্ছে। পরবর্তীতে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অভিযুক্ত ওই শিক্ষককে পুরস্কার প্রদান করা হবে বলে নিশ্চিত করেছেনে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো.শাহজাহান মিয়া
এর আগে চাঁচুড়ী পুরুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলামের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পত্তি অর্জন ও করোনার টীকার জন্য টাকা আদায় এবং দুর্নীতিসহ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে মিথ্যা তথ্য প্রদান করায় ওই শিক্ষকের এমপিও স্থগিত করে গত মার্চ মাস থেকে বেতন-ভাতাদি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে।
জানা যায়,গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষা কর্মকর্তা (মাধ্যমিক-২) মো.তরিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে জানানো হয়,দুদক ঢাকা কার্যালয়ের স্মারক নং৩৯১৪৩,তাং-২৬/১০/২০২২,মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং-২২/৫৭,তাং -২৭/১০/২০২২,শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মারক নং-৩৭৩,তাং-৩০/১০/২০২২,উপ পরিচালকের কার্যালয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা,খুলনা অঞ্চল,খুলনার স্মারক নং-১৭-৫৪,তাং-১২/০১/২৩ সূত্রের প্রেক্ষিতে চাঁচুড়ী পুরুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম অবৈধ সম্পত্তি অর্জন ও করোনার টীকার জন্য টাকা আদায় সংক্রান্ত বিষয়ে মিথ্যা তথ্য প্রদান করায় এমপিও বন্ধ/স্থগিত করার বিষয়ে কারণ দর্শাতে বলা হয়। এরই প্রেক্ষিতে চলতি বছর মার্চ মাস থেকে ওই শিক্ষকের বেতন-ভাতাদি বন্ধ রয়েছে। ইতিপূর্বে প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলামের বিরুদ্ধে আনা নিয়োগ বাণিজ্য, প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাত করে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে বিপুল অঙ্কের অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়া,বিদ্যালয়ের উন্নয়ন ফান্ডের অর্থ আত্মসাৎ ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্থ আদায় করাসহ করোনার টিকা রেজিষ্ট্রেশন ও নির্ধারিত কেন্দ্রে নেয়ার নামে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর নিকট থেকে টাকা আদায় করা ও আর্থিক অনিয়মসহ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করে গেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা,খুলনা অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর শেখ হারুণ অর রশীদ। চাঁচুড়ী পুরুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির বিদ্যোৎসাহী সদস্য ফসিয়ার রহমান মোল্যা অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের পক্ষে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বরাবর দাখিলকৃত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই তদন্ত পরিচালিত হয়।
অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে,২০১৪ সালে দুর্নীতি ও মোটা অঙ্কের উৎকোচের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে নিয়োগ পাওয়া প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব নিয়েই সরকারি সকল নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে স্কুলের শিক্ষক ও বেশ কয়েকজন কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন। প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাত করে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে বিপুল অঙ্কের অবৈধ সম্পদেও মালিক হয়েছেন। বিদ্যালয়ের উন্নয়ন ফান্ডের অর্থ আত্মসাৎ ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্থ আদায় করছেন। বিভিন্ন ব্যয় দেখিয়ে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রতি বছর ভর্তিচ্ছু প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর নিকট থেকে মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের বাইরে ভর্তি ফরম বাবদ নিয়মিত জনপ্রতি একটি নির্দিষ্ট হারে টাকা আদায় করা হয়। রেজিস্ট্রেশন ফিসহ কম্পিউটার কার্যক্রম খাতে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে বছরে আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা। মহামারী করোনায় বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে বেতনের সাথে আনুষঙ্গিক চাঁদা তুলেছেন তিনি। এমনকি করোনার টিকায় শিক্ষার্থীর নিকট থেকে টাকা আদায় এবং বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ ভাড়া দিয়ে অর্থ আতœসাত করারও অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণ, সভাপতিকে ম্যানেজ করে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের মোটা দাগের আয় হওয়া অর্থ আতœসাত করে বিদেশে পাচার করার মতো অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
অভিযোগগুলো তদন্তে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা,খুলনা অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর শেখ হারুণ অর রশীদকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। পরে তদন্তে প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম অবৈধ সম্পত্তি অর্জন ও করোনার টীকার জন্য টাকা আদায় এবং দুর্নীতিসহ সকল অভিযোগের বিষয়ে মিথ্যা তথ্য প্রদান করায় প্রাথমিকভাবে ওই শিক্ষকের এমপিও স্থগিত করে বেতন-ভাতাদি বন্ধ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য প্রতিষ্ঠানের এক প্রধান শিক্ষক জানান,প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলামের কীভাবে আবেদন করে শ্রেষ্ঠ হলেন তা তাদের জানা নেই। যেহেতু তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত চলমান। তাই এ বিষয়ে প্রশাসনই ভালো জানে, কীভাবে তাঁকে শ্রেষ্ঠ নির্বাচন করা হলো।
এ প্রসঙ্গে জেলা শিক্ষা অফিসার মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন.উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচনের বিষয়টি সম্পর্কে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাই ভালো বলতে পারবেন। আমি যেহেতু কর্মস্থলে নতুন যোগদান করেছি;তাই প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে অবগত নই। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
একই প্রসঙ্গে কালিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো.শাহজাহান মিয়া জানান,‘স্কুল পর্যায়ে প্রধান শিক্ষকের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার গ্রহণে উপজেলা পর্যায়ে একটিমাত্র আবেদন পড়ায় আশরাফুল ইসলামকেই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ঘোষণা করা হয়েছে। তবে আশরাফুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না; এ বিষয়টি তাঁকে কেউ জানায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বলেন,‘ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমাকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত করেছেন। কিভাবে করেছেন;তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হওয়ায় প্রাথমিকভাবে বেতন-ভাতাদি বন্ধ হওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে মন্তব্য না করে এড়িয়ে যান তিনি।